ফেসবুক ইনকামের খপ্পরে তরুণ প্রজন্ম

নৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়

মো: শামীম মিয়া ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:১৮ অপরাহ্ণ
ফেসবুক ইনকামের খপ্পরে তরুণ প্রজন্ম

ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ মানবসভ্যতাকে এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিপ্লব আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে করেছে সহজ, গতিশীল ও বিশ্বমুখী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষত ফেসবুক, একসময় নিছক যোগাযোগের বাহন হিসেবে আবির্ভূত হলেও এখন তা এক বৈশ্বিক বাজারে রূপান্তরিত হয়েছে। ভিডিও কনটেন্ট, বিজ্ঞাপন প্রচার, রিলস, শর্টস, ইনফ্লুয়েন্সার কার্যক্রম-সব মিলিয়ে ফেসবুক আজ একটি বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষেত্র। তরুণ সমাজ এখানে আয়ের আশায় ঝুঁকছে এবং এক অর্থে ডিজিটাল উদ্যোক্তা হয়ে উঠছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই আয়ের প্রতিযোগিতা কি কেবল আর্থিক সম্ভাবনা তৈরি করছে, নাকি তা সমাজের নৈতিক ভিত্তি ও সামাজিক সংহতিকে ভেঙে দিচ্ছে? বাস্তবতা হলো, ফেসবুক ইনকামের অন্ধ দৌড়ে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিকতা ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে। ফলে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিক দেউলিয়াপনা তীব্রতর হচ্ছে।

আয়ের প্রতিযোগিতা: সত্য-মিথ্যার বিলোপ ফেসবুক ইনকামের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হলো প্রধান চালিকা শক্তি। কে কত দ্রুত ভাইরাল হবে, কে কত ভিউ পাবে, কে কত লাইক সংগ্রহ করবে-এই প্রতিযোগিতার তাড়না অনেককে ঠেলে দিচ্ছে মিথ্যা, গুজব ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট তৈরি করার দিকে। জনপ্রিয়তা অর্জনের নেশায় কেউ ভুয়া সংবাদের আশ্রয় নিচ্ছে, কেউ অশ্লীলতার প্রদর্শনী করছে, আবার কেউ অন্যের চরিত্রহনন করে দর্শক আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এভাবে ফেসবুকীয় ইনকাম কেবল অর্থ আয়ের উপায় নয়, বরং সত্য ও নৈতিকতার অবমূল্যায়নের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। এর ফলে সমাজে ভুয়া তথ্যের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, বিভ্রান্ত মানুষ ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে, আর সমষ্টিগতভাবে সামাজিক শান্তি নষ্ট হচ্ছে।

সামাজিক বন্ধনের ক্ষয়িষ্ণুতা : মানুষ একটি সামাজিক প্রাণী। সম্পর্ক, পারস্পরিক আস্থা, আড্ডা, সাহিত্য, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সমাজকে একত্রে বেঁধে রাখে। কিন্তু ফেসবুক ইনকামের প্রতিযোগিতা বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকে ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছে। আজ পরিবারে সন্তান বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় কাটানোর পরিবর্তে লাইভ সম্প্রচারে ব্যস্ত থাকে। ভাই-বোন কিংবা বন্ধুত্বের বন্ধন ভেঙে পড়ছে ভার্চুয়াল জনপ্রিয়তার মোহে। সমাজের আন্তরিক যোগাযোগকে প্রতিস্থাপিত করছে সংখ্যাগত মাপকাঠি-লাইক, শেয়ার ও ফলোয়ারের অঙ্ক। এর ফলে সমাজ হারাচ্ছে তার উষ্ণতা, আন্তরিকতা ও সংহতি।

নৈতিকতার অবক্ষয় ও মূল্যবোধের দেউলিয়াপনা : নৈতিকতা হলো সভ্যতার মূল স্তম্ভ। কিন্তু ফেসবুক ইনকামের দৌড়ে নৈতিকতা যেন অবান্তর এক ধারণা। কিশোর-কিশোরীরা রাত জেগে ভিডিও বানাচ্ছে, শিক্ষাজীবন অবহেলা করছে, অশ্লীলতা ও উচ্ছৃঙ্খলতাকে বিনোদন হিসেবে উপস্থাপন করছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে পর্যন্ত কনটেন্টে রূপান্তর করা হচ্ছে। এই প্রবণতা শুধু ব্যক্তিকে নয়, সমাজকেও ধ্বংস করছে। কারণ নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে যে জনপ্রিয়তা ও অর্থ অর্জিত হয়, তা কখনো স্থায়ী কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। বরং তা তৈরি করে এক দেউলিয়া মানসিকতা, যেখানে সত্য, মানবিকতা ও আত্মমর্যাদা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।

অপসংস্কৃতির প্রসার ও ভোগবাদী সমাজ: ফেসবুক ইনকামের মাধ্যমে তরুণ সমাজে এক ভয়ংকর অপসংস্কৃতির প্রসার ঘটছে। ভুয়া প্র্যাঙ্ক, কৃত্রিম ঝগড়া, নোংরা কৌতুক, অশ্লীল ভঙ্গি-সবই দর্শক বাড়ানোর হাতিয়ার। এ ধরনের কনটেন্ট রুচিবোধ ধ্বংস করছে এবং ভোগবাদী মানসিকতাকে উসকে দিচ্ছে। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক দিক হলো, অর্থ আয়ের কারণে এই অপসংস্কৃতি সামাজিকভাবে এক প্রকার নীরব স্বীকৃতি পাচ্ছে। অনেক অভিভাবকও সন্তানের আয়ের মোহে এই কর্মকাণ্ডকে মেনে নিচ্ছেন। ফলে সমাজে এক অদ্ভুত দ্বিমুখী মানসিকতা তৈরি হচ্ছে, যেখানে অর্থকে নৈতিকতার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হচ্ছে।

ব্যক্তিস্বাধীনতার সংকট ও গোপনীয়তার লঙ্ঘন : ফেসবুক ইনকামের আরেকটি বড় সমস্যা হলো ব্যক্তিগত জীবনের বাণিজ্যিকীকরণ। পরিবার, বন্ধু বা ব্যক্তিগত আবেগঘন মুহূর্তকে লাইভে রূপান্তর করা আজ সাধারণ ঘটনা। এতে গোপনীয়তা ধ্বংস হচ্ছে, ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি এক ধরনের মানসিক চাপ ও সামাজিক অবিশ্বাস তৈরি করছে। কারণ প্রত্যেকে নিজের জীবনের অন্তরঙ্গতাকে প্রদর্শনীতে রূপান্তর করছে, যা সম্পর্কের উষ্ণতাকে ধ্বংস করছে এবং পারিবারিক বিশ্বাসকে দুর্বল করছে।

ইতিবাচক সম্ভাবনা: ফেসবুকের ইতিবাচক ব্যবহার অস্বীকার করা যায় না। অনেকে শিক্ষামূলক কনটেন্ট তৈরি করছেন, সংস্কৃতি ও সাহিত্য প্রচার করছেন, সামাজিক সচেতনতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এসব কনটেন্ট সত্যিই সমাজকে আলোকিত করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো-ইতিবাচক কনটেন্ট খুব কমই ভাইরাল হয়। দর্শকরা সহজে আকৃষ্ট হয় নাটকীয়তা, অশ্লীলতা ও কৃত্রিম সংঘর্ষে। ফলে ইতিবাচক কনটেন্ট সীমিত সাড়া পেলেও নেতিবাচক কনটেন্টের বিস্তার বিস্ময়কর হারে বাড়ছে। এ কারণেই ফেসবুক ইনকামের ইতিবাচক সম্ভাবনা বাস্তবে ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির করণীয় : ১. ব্যক্তিগত সচেতনতা: তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে হবে যে অর্থ সব নয়। নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অর্জিত জনপ্রিয়তা ক্ষণস্থায়ী। ২. পারিবারিক ভূমিকা: অভিভাবকদের উচিত সন্তানকে বিকল্প সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত করা, সময় দেওয়া এবং নৈতিকতার গুরুত্ব বোঝানো। ৩. শিক্ষা ও সংস্কৃতি: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল সাক্ষরতা ও গণমাধ্যম নৈতিকতা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সাহিত্যচর্চা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তরুণদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। ৪. রাষ্ট্র ও আইন: ভুয়া খবর, বিভ্রান্তিকর তথ্য ও অশ্লীল কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি। একই সঙ্গে ইতিবাচক কনটেন্ট নির্মাণে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। ৫. সামাজিক আন্দোলন: সমাজে নৈতিকতা, মানবিকতা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনার জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

অতএব বলাই যায় ফেসবুক ইনকাম নিঃসন্দেহে তরুণ সমাজের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। কিন্তু এর অন্ধকার দিক ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে। নৈতিকতা ধ্বংস হচ্ছে, সামাজিক বন্ধন ভেঙে পড়ছে, পারিবারিক সম্পর্ক ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে। মানবিকতা যদি অর্থের কাছে পরাজিত হয়, তবে সেই সমাজের ভবিষ্যৎ কেবল ধ্বংসের দিকেই যাবে। আজ সময় এসেছে আত্মসমালোচনার, দায়িত্বশীলতার। তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে হবে, অর্থ নয়, মানবিকতা ও সামাজিকতা হলো জীবনের প্রকৃত সম্পদ। রাষ্ট্র, পরিবার ও সমাজকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে এই অবক্ষয় রোধে। অন্যথায়, ফেসবুক ইনকামের খপ্পরে আমাদের প্রজন্ম হারাবে তার নৈতিকতা, সমাজ হারাবে তার সংহতি, আর সভ্যতা হারাবে তার মৌলিক মহিমা।

মো: শামীম মিয়া, কলামিস্ট

Read more — মতামত
← Home